গলা ব্যথা: কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা – একটি বিস্তারিত গাইড। Sore Throat: Causes, Symptoms, Remedies, and Treatment – ​​A Detailed Guide.

ভূমিকা

গলা ব্যথা একটি খুব সাধারণ সমস্যা যা শিশু, বড়, বয়স্ক সকলেরই জীবনে একাধিকবার হতে পারে। এটি সাধারণত মৌসুমি সংক্রমণ, ঠান্ডা লাগা, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। তবে কখনো কখনো গলা ব্যথা জটিল রোগেরও ইঙ্গিত দিতে পারে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা গলা ব্যথার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার, ও চিকিৎসা সম্পর্কে সহজ ও বিস্তারিত আলোচনা করব।

গলা ব্যথা কী?

গলা ব্যথা বলতে বোঝায় গলার অভ্যন্তরে অস্বস্তি, জ্বালা বা ব্যথা অনুভব হওয়া। এটি গলার পিছনের অংশ (pharynx), টনসিল (tonsils) বা কণ্ঠনালির (larynx) যেকোনো স্থানে হতে পারে। ব্যথা কখনো হালকা, আবার কখনো তীব্র হতে পারে এবং এটি খাবার গিলতে কষ্টকর করে তোলে।

গলা ব্যথা এর ডিজিটার ছবি বা ফটো

গলা ব্যথার প্রকারভেদ

গলা ব্যথা মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:

১. ভাইরাল গলা ব্যথা

– সাধারণ সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, করোনা ভাইরাস ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে।
– সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা হয়।
– নিজে নিজেই সেরে যায় ৫-৭ দিনের মধ্যে।

২. ব্যাকটেরিয়াজনিত গলা ব্যথা

– স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus) নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়।
– ব্যথা তীব্র হয় এবং জ্বর, টনসিল ফুলে যাওয়া দেখা যায়।
– চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

৩. এলার্জিজনিত ও অন্যান্য কারণ

– ধুলাবালি, ধূমপান, এসিডিটি, গলা পরিষ্কার করা, কণ্ঠস্বরের অতিরিক্ত ব্যবহার ইত্যাদির কারণে গলা ব্যথা হতে পারে।

গলা ব্যথার সাধারণ কারণসমূহ

১. ভাইরাল সংক্রমণ – সাধারণ ঠান্ডা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, করোনা ভাইরাস।
২. ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ – স্ট্রেপথ্রোট, ডিফথেরিয়া।
৩. টনসিলাইটিস – টনসিল ফুলে যাওয়া ও ব্যথা হওয়া।
৪. পোস্টনাসাল ড্রিপ – নাক দিয়ে কফ গলায় পড়লে।
৫. ধূমপান ও দূষণ – দীর্ঘসময় ধোঁয়া বা ধুলার সংস্পর্শে থাকলে।
৬. এসিড রিফ্লাক্স – পাকস্থলীর অ্যাসিড গলায় উঠে আসা।
৭. অতিরিক্ত কথা বলা বা চিৎকার করা – গলার উপর চাপ পড়ে।
৮. অ্যালার্জি – বিভিন্ন খাদ্য, ধুলাবালি, ফুলের রেণু ইত্যাদি।
৯. নাকের পেছনের অংশে ইনফেকশন
১০. টিউমার বা ক্যান্সার – গলায় দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার পেছনে বিরল কিন্তু গুরুতর কারণ।

গলা ব্যথার লক্ষণসমূহ

গলা ব্যথার সঙ্গে যুক্ত সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:

  • গিলতে কষ্ট হওয়া

  • গলায় জ্বালা বা খুসখুসে ভাব

  • কণ্ঠস্বর বসে যাওয়া

  • গলা শুকিয়ে যাওয়া

  • গলায় ফোলা অনুভব

  • জ্বর বা কাঁপুনি

  • মাথাব্যথা

  • কানের ব্যথা

  • গলায় ঘা বা সাদা স্পট

  • গলা পরিষ্কার করতে বারবার কাশি

কখন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে?

গলা ব্যথা সাধারণত কিছুদিনে সেরে যায়, তবে নিচের যেকোনো উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত:

  • ব্যথা ৭ দিনের বেশি স্থায়ী হলে

  • খাবার বা পানীয় গিলতে পারছেন না

  • গলার একপাশ ফুলে গেলে

  • কণ্ঠস্বর সম্পূর্ণ হারিয়ে গেলে

  • রক্তবমি বা মুখে রক্ত দেখা গেলে

  • গলায় চাকা বা ঘা দেখা দিলে

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হলে

গলা ব্যথার পরীক্ষা ও নির্ণয়

চিকিৎসক রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করে কিছু টেস্ট দিয়ে থাকেন। যেমন:

  1. গলার সোয়াব টেস্ট (Throat Swab) – ব্যাকটেরিয়া আছে কি না তা চেক করতে।

  2. CBC (Complete Blood Count) – ইনফেকশন বোঝার জন্য।

  3. ASO Titre – স্ট্রেপ সংক্রমণ শনাক্ত করতে।

  4. X-ray অথবা CT Scan – দীর্ঘমেয়াদি বা জটিল ক্ষেত্রে।

  5. Laryngoscopy – গলার ভিতরের অংশ সরাসরি দেখতে।

গলা ব্যথার ঘরোয়া প্রতিকার

অনেক সময় গলা ব্যথা ঘরে বসেই কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিতে উপশম করা যায়:

১. লবণ পানি দিয়ে গার্গল

– গরম পানিতে এক চা চামচ লবণ মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার গার্গল করুন।

২. আদা ও মধুর চা

– আদা, মধু ও লেবু মিশিয়ে হালকা গরম পানিতে পান করলে আরাম পাওয়া যায়।

৩. বাষ্প গ্রহণ (Steam Inhalation)

– নাক ও গলার প্যাসেজ পরিষ্কার রাখতে সহায়ক।

৪. গরম পানীয় পান

– স্যুপ, হালকা গরম দুধ বা লেবু পানি উপকারী।

৫. শরীরকে বিশ্রাম দিন

– অতিরিক্ত কথা না বলা ও ঘুম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

৬. ধূমপান ও ধুলাবালি থেকে দূরে থাকুন

– পরিস্থিতি আরও খারাপ না করার জন্য এগুলো এড়িয়ে চলুন।

গলা ব্যথার চিকিৎসা

১. ওষুধ

– ভাইরাল হলে অ্যান্টিভাইরাল প্রয়োজন হয় না, শুধু লক্ষণ উপশমের জন্য ওষুধ দেওয়া হয়।
– ব্যাকটেরিয়াল হলে অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন অ্যামোক্সিসিলিন, সেফাড্রক্সিল ইত্যাদি)।
– ব্যথা ও জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন।
– অ্যান্টাসিড বা এসিড রিফ্লাক্সের জন্য ওষুধ।

২. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

– Belladonna: হঠাৎ তীব্র ব্যথায়।
– Hepar Sulph: পুঁজযুক্ত ইনফেকশন হলে।
– Merc Sol: রাতের বেলায় ব্যথা বেড়ে গেলে।
– Phytolacca: গিলতে ব্যথা, টনসিল ফুলে গেলে।
– Kali Bich: গলা পরিষ্কার করতে কাশি হলে।

হোমিওপ্যাথি ব্যবহারের আগে একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

শিশুদের গলা ব্যথা

শিশুরা খুব সহজেই ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। তাদের গলা ব্যথার লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে:

  • খাওয়া বন্ধ করে দেয়

  • কান্না করে

  • উচ্চ জ্বর

  • ঘন ঘন ঘুমায়

শিশুদের ক্ষেত্রে নিজে থেকে ওষুধ না দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই উত্তম।

গলা ব্যথা প্রতিরোধে করণীয়

১. নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন
২. হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখুন
৩. ঠান্ডা বা ইনফেকটেড ব্যক্তিদের কাছ থেকে দূরে থাকুন
৪. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
৫. ধূমপান ও ধুলোবালিমুক্ত পরিবেশে থাকুন
৬. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী রাখুন
৭. ঠান্ডা পানি, বরফ, কোল্ড ড্রিংক থেকে বিরত থাকুন

FAQ – প্রায় জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

প্রশ্ন: গলা ব্যথা হলে কি অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হবে?
উত্তর: না, সব সময় নয়। যদি ব্যাকটেরিয়াজনিত হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক নিতে হয়।

প্রশ্ন: গলা ব্যথা কি করোনা ভাইরাসের লক্ষণ হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, হতে পারে। তবে একে নিশ্চিত করতে করোনা টেস্ট করা জরুরি।

প্রশ্ন: কতদিনের মধ্যে গলা ব্যথা সেরে যায়?
উত্তর: ভাইরাল হলে সাধারণত ৫-৭ দিনের মধ্যে সেরে যায়।

প্রশ্ন: গলা ব্যথা হলে কি আইসক্রিম খাওয়া ঠিক?
উত্তর: না, ঠান্ডা খাবার ব্যথা আরও বাড়াতে পারে।

উপসংহার

গলা ব্যথা একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা। এর পেছনে কারণ যতই সাধারণ হোক না কেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে তা জটিল রূপ নিতে পারে। ঘরোয়া প্রতিকার এবং সচেতনতা গলা ব্যথা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। তবে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


Next Post Previous Post