চোখের ছানিপড়া ও চোখের ছানি পড়া রোগের সমাধান। Cataracts and solutions for cataracts.
ভূমিকা
মানুষের দৃষ্টিশক্তি জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। আমরা যা দেখি, যা বুঝি, যা অনুভব করি—তার বড় অংশ চোখের মাধ্যমে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে অথবা কিছু বিশেষ কারণে চোখের ভেতরে ছানিপড়া বা ক্যাটারাক্ট (Cataract) সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি এমন একটি চক্ষুরোগ, যেখানে চোখের ভেতরের লেন্স বা ক্রিস্টালাইন লেন্স ঘোলা হয়ে যায়। ফলে ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, অনেক সময় একেবারেই দৃষ্টিশক্তি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো—
-
চোখের ছানি বা ছানিপড়া কী?
-
ছানির প্রকারভেদ
-
ছানি পড়ার কারণ
-
এর লক্ষণ ও ঝুঁকি
-
প্রতিরোধের উপায়
-
প্রাথমিক সমাধান
-
আধুনিক চিকিৎসা ও অপারেশন পদ্ধতি
-
চোখের যত্ন ও পরামর্শ
এটি একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন হিসেবে কাজ করবে, বিশেষ করে যারা চোখের সমস্যায় ভুগছেন বা বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান।
চোখের ছানিপড়া (Cataract) কী?
চোখের ভেতরে একটি প্রাকৃতিক লেন্স থাকে যা স্বচ্ছ এবং এর কাজ হলো আলোকে ভেঙে রেটিনায় পাঠানো। যখন এই লেন্স বিভিন্ন কারণে ঘোলা হয়ে যায়, তখন তাকে ছানি পড়া বলা হয়।
ছানি পড়লে—
-
আলো ঠিকভাবে চোখের ভেতর প্রবেশ করতে পারে না।
-
ছবি স্পষ্টভাবে দেখা যায় না।
-
ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে থাকে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি একটি সাধারণ বার্ধক্যজনিত সমস্যা, তবে কম বয়সেও নানা কারণে দেখা দিতে পারে।
ছানির প্রকারভেদ
চোখের ছানি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। সাধারণত নিচের ধরণগুলো বেশি দেখা যায়:
১. নিউক্লিয়ার ক্যাটারাক্ট
-
চোখের লেন্সের মাঝখানে বা কেন্দ্রস্থলে তৈরি হয়।
-
বয়সজনিত কারণে বেশি হয়।
-
ধীরে ধীরে লেন্সের কেন্দ্র শক্ত ও ঘোলা হয়ে যায়।
২. কর্টিকাল ক্যাটারাক্ট
-
লেন্সের চারপাশ বা বাইরের অংশ থেকে শুরু হয়।
-
সাদা দাগের মতো ছোপ দেখা যায়।
-
ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
৩. পোস্টেরিয়র সাব-ক্যাপসুলার ক্যাটারাক্ট
-
লেন্সের পেছনের দিকে তৈরি হয়।
-
দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
-
আলোতে তাকালে ঝাপসা দেখা যায় এবং পড়াশোনার সময় সমস্যা হয়।
৪. জন্মগত ক্যাটারাক্ট
-
অনেক শিশুর জন্মের সময় চোখে ছানি থাকতে পারে।
-
জিনগত বা মায়ের গর্ভাবস্থার সমস্যার কারণে হয়।
৫. সেকেন্ডারি ক্যাটারাক্ট
-
অন্য চোখের রোগ বা আঘাতের ফলে হতে পারে।
-
ডায়াবেটিস, গ্লুকোমা বা ওষুধের প্রভাবে হয়ে থাকে।
চোখে ছানি পড়ার কারণ
চোখে ছানি পড়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—
-
বয়সজনিত কারণ – বয়স বাড়ার সাথে সাথে লেন্স স্বাভাবিকভাবে ঘোলা হয়ে যায়।
-
ডায়াবেটিস – উচ্চ রক্তে শর্করা ছানি পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়।
-
চোখে আঘাত – দুর্ঘটনা বা আঘাতের কারণে ছানি হতে পারে।
-
জিনগত প্রভাব – পরিবারে কারও ছানি থাকলে ঝুঁকি বেশি।
-
অতিরিক্ত সূর্যের আলো – অতিবেগুনি রশ্মি লেন্সের ক্ষতি করে।
-
ধূমপান ও মদ্যপান – চোখের লেন্সের প্রোটিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
স্টেরয়েড বা কিছু ওষুধ – দীর্ঘমেয়াদে খেলে ছানি দেখা দেয়।
-
অপুষ্টি – ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘ই’ এর ঘাটতি।
চোখে ছানি পড়ার লক্ষণ
প্রাথমিকভাবে ছানির লক্ষণগুলো সহজে বোঝা যায় না। তবে ধীরে ধীরে কিছু পরিবর্তন স্পষ্ট হয়, যেমন—
-
দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া
-
আলোতে তাকালে চোখে ঝলকানি
-
রঙ ঠিকমতো দেখা না যাওয়া
-
পড়তে বা লিখতে অসুবিধা হওয়া
-
গাড়ি চালানোর সময় রাতে সমস্যা
-
চশমার পাওয়ার বারবার পরিবর্তন করতে হয়
-
ডাবল ভিশন বা এক বস্তুকে একাধিক দেখা
ছানি পড়ার ঝুঁকি
যারা নিচের অবস্থায় আছেন, তাদের মধ্যে ছানি পড়ার ঝুঁকি বেশি:
-
৫০ বছরের ঊর্ধ্বে
-
ডায়াবেটিস রোগী
-
ধূমপায়ী
-
অতিরিক্ত রোদে কাজ করেন
-
দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ব্যবহার করছেন
-
পরিবারে ছানির ইতিহাস আছে
ছানি প্রতিরোধে করণীয়
যদিও ছানি সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করা যায় না, তবে কিছু নিয়ম মানলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। যেমন—
-
সানগ্লাস ব্যবহার – সূর্যের আলোয় অতিবেগুনি রশ্মি থেকে চোখ রক্ষা করা।
-
সুষম খাবার খাওয়া – ভিটামিন এ, সি, ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
-
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ – রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখা।
-
ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ।
-
চোখে আঘাত এড়ানো – কাজ করার সময় সেফটি গ্লাস ব্যবহার।
-
নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা – বছরে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করা।
ছানি পড়ার প্রাথমিক সমাধান
প্রাথমিক অবস্থায় ছানি পড়লে সাধারণত জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন করলে দৃষ্টি উন্নত করা যায়। যেমন—
-
পর্যাপ্ত আলোতে পড়াশোনা করা।
-
চশমা পরিবর্তন করে ব্যবহার।
-
অ্যান্টি-গ্লেয়ার চশমা ব্যবহার।
-
উজ্জ্বল আলো ব্যবহার।
-
চোখের ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া (চিকিৎসকের পরামর্শে)।
ছানির আধুনিক চিকিৎসা
চোখে একবার ছানি পড়লে ওষুধে তা দূর করা সম্ভব নয়। একমাত্র সমাধান হলো অপারেশন। বর্তমানে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে ছানি অপারেশন করা হয় যা নিরাপদ ও কার্যকর।
১. ফ্যাকো সার্জারি (Phacoemulsification)
-
সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি।
-
ছোট কাটা দিয়ে আল্ট্রাসনিক ভিব্রেশন ব্যবহার করে লেন্স ভেঙে ফেলা হয়।
-
কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করা হয়।
-
অপারেশনের পর দ্রুত দৃষ্টি ফিরে আসে।
২. এক্সট্রাক্যাপসুলার ক্যাটারাক্ট এক্সট্রাকশন (ECCE)
-
লেন্সের বড় অংশ বের করা হয়।
-
সেলাই দিতে হয়।
-
বর্তমানে কম ব্যবহৃত।
৩. ইন্ট্রাক্যাপসুলার ক্যাটারাক্ট এক্সট্রাকশন (ICCE)
-
পুরো লেন্স সরিয়ে ফেলা হয়।
-
এখন আর সচরাচর ব্যবহৃত হয় না।
৪. লেজার ক্যাটারাক্ট সার্জারি
-
আধুনিক ও ব্যয়বহুল পদ্ধতি।
-
লেজারের মাধ্যমে ছানি অপসারণ করা হয়।
-
খুব দ্রুত এবং ব্যথাহীন।
অপারেশনের পর করণীয়
-
চিকিৎসকের দেওয়া ড্রপ ব্যবহার করা।
-
চোখে ময়লা বা পানি ঢুকতে না দেওয়া।
-
ভারী কাজ এড়িয়ে চলা।
-
রোদে গেলে সানগ্লাস ব্যবহার।
-
নিয়মিত ফলো-আপ পরীক্ষা করা।
চোখের যত্ন ও স্বাস্থ্য টিপস
-
সুষম খাবার যেমন গাজর, মাছ, শাকসবজি খেতে হবে।
-
পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।
-
ধুলোবালি থেকে চোখ রক্ষা করতে হবে।
-
কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যবহার করলে প্রতি ২০ মিনিটে চোখ বিশ্রাম দিতে হবে।
-
চোখ চুলকানো বা চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
উপসংহার
চোখের ছানিপড়া একটি সাধারণ কিন্তু গুরুতর চক্ষু রোগ। এটি উপেক্ষা করলে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে এবং নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করলে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। আধুনিক সার্জারি পদ্ধতিতে ছানি পুরোপুরি দূর করা সম্ভব এবং দৃষ্টি আগের মতো ফিরে আসে।
তাই চোখে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা ঝাপসা দেখলে দেরি না করে দ্রুত চক্ষু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।
