বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো আলোচনা করা হয়েছে। The main principles of Buddhism are discussed.
ভূমিকা
বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহামতি গৌতম বুদ্ধ সত্যের সন্ধানে সাধনা করে যে আলোকপ্রাপ্তি লাভ করেন, তার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে এই ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিক মুক্তির শিক্ষা দেয় না, এটি মানব জীবনে নৈতিকতা, শান্তি, সহানুভূতি ও সত্যের অনুশীলনকেই প্রধান ধর্মনীতি হিসেবে গুরুত্ব দেয়।
এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো নিয়ে, যা একদিকে ব্যক্তিগত জীবনকে সৎ ও শান্তিপূর্ণ করে তোলে, অন্যদিকে সমাজে ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে।
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস ও সূচনা
বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা হয়েছিল বর্তমান নেপালের লুম্বিনিতে সিদ্ধার্থ গৌতমের জন্মের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি "বুদ্ধ" নামে পরিচিত হন। রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা ত্যাগ করে তিনি জীবনের দুঃখ, রোগ, বার্ধক্য ও মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে সাধনায় নিমগ্ন হন। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি বোধি বৃক্ষের নিচে জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়ে "মহামতি বুদ্ধ" রূপে আবির্ভূত হন।
তার শিক্ষা ছিল দুঃখের কারণ, দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় এবং মধ্যমার্গ অবলম্বনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এ শিক্ষা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতি ও নিয়ম।
বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি – চার আর্য সত্য (চতুরার্য্য সত্য)
বৌদ্ধ ধর্মের নীতি বোঝার আগে "চার আর্য্য সত্য" জানা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটাই সমগ্র বৌদ্ধ দর্শনের ভিত্তি।
১. দুঃখ সত্য (দুঃখের অস্তিত্ব আছে): জন্ম, বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু – সবই দুঃখ।
২. দুঃখ সমুদয় সত্য (দুঃখের কারণ): তৃষ্ণা ও আসক্তিই দুঃখের মূল কারণ।
৩. দুঃখ নিরোধ সত্য (দুঃখ নিবারণ সম্ভব): আসক্তি ও লোভ দূর করলে দুঃখ নিবারণ হয়।
৪. দুঃখ নিরোধ গামিনী প্রতিপদ সত্য (দুঃখ নিবারণের পথ): অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ মুক্তির পথ।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতি
১. অষ্টাঙ্গিক মার্গ (The Noble Eightfold Path)
বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতি হলো অষ্টাঙ্গিক মার্গ। এটি দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের সঠিক পথ।
অষ্টাঙ্গিক মার্গের আটটি অংশ হলো:
-
সম্যক দৃষ্টি (Right View): জীবনের সত্য ও বাস্তবতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা।
-
সম্যক সংকল্প (Right Intention): মনের ভেতর শুভ চিন্তা, দয়া, অহিংসা ধারণ করা।
-
সম্যক বাক্ (Right Speech): মিথ্যা, কুৎসা, অশ্লীলতা থেকে বিরত থেকে সত্য ও সদ্বাক্য বলা।
-
সম্যক কর্ম (Right Action): নৈতিক ও সৎ কাজ করা, চুরি, হত্যা, অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকা।
-
সম্যক আজীবিকা (Right Livelihood): এমন পেশা বেছে নেওয়া যা সমাজে ক্ষতি আনে না।
-
সম্যক ব্যায়াম (Right Effort): মনের খারাপ প্রবৃত্তি দমন করে সৎ চিন্তা ও কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া।
-
সম্যক স্মৃতি (Right Mindfulness): মনকে সচেতন রাখা এবং প্রতিটি কাজে মনোযোগী হওয়া।
-
সম্যক সমাধি (Right Concentration): ধ্যানের মাধ্যমে মনকে স্থির ও শান্ত রাখা।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় একটি পূর্ণাঙ্গ নৈতিক শিক্ষা।
২. পাঁচ শীল (Pañca Śīla)
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দৈনন্দিন জীবনে অনুসরণীয় মূল পাঁচটি শপথ বা নিয়ম হলো পাঁচ শীল। এগুলো হলো:
-
প্রাণী হত্যা না করা (অহিংসা পালন করা)।
-
চুরি বা অন্যের সম্পদ গ্রহণ না করা।
-
কামাচার থেকে বিরত থাকা।
-
মিথ্যা বাক্য বা কুৎসা না বলা।
-
মাদক বা মাদকদ্রব্য থেকে বিরত থাকা।
এই পাঁচ শীল একজন সাধারণ মানুষকে নৈতিক, সৎ এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পথে পরিচালিত করে।
৩. দশ শীল (Dasa Śīla)
সন্ন্যাসীদের জন্য বৌদ্ধ ধর্মে কিছু কঠোর নিয়ম রয়েছে, যাকে বলা হয় দশ শীল। এগুলো হলো:
-
প্রাণী হত্যা না করা।
-
চুরি না করা।
-
কামাচার থেকে বিরত থাকা।
-
মিথ্যা না বলা।
-
মাদক থেকে বিরত থাকা।
-
দুপুরের পর আহার না করা।
-
নৃত্য, গান বা বিনোদনমূলক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা।
-
অলংকার বা সুগন্ধি ব্যবহার না করা।
-
উঁচু বা আরামদায়ক বিছানায় না শোয়া।
-
সোনা-রূপার মতো মূল্যবান বস্তু ব্যবহার না করা।
৪. করুণাময়তা ও অহিংসা
বৌদ্ধ ধর্মের মূল নীতি হলো করুণা (Compassion) এবং অহিংসা (Non-violence)। প্রতিটি প্রাণী সমানভাবে সম্মানের যোগ্য। কারো ক্ষতি না করা এবং সকলের মঙ্গল কামনা করা বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান নীতি।
৫. ধ্যান ও মনঃসংযম
ধ্যান বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। ধ্যানের মাধ্যমে মনকে স্থির রাখা, লোভ-ক্রোধ-অহংকার দমন করা এবং আত্মশুদ্ধি অর্জন করা যায়।
৬. মহাযান ও হীনযান প্রথায় ধর্মনীতি
বৌদ্ধ ধর্মের দুই প্রধান শাখা হলো মহাযান ও হীনযান (থেরবাদ)।
-
হীনযান: ব্যক্তিগত মুক্তির ওপর জোর দেয়, কঠোর শীল ও ধ্যানচর্চা অনুসরণ করে।
-
মহাযান: সকল প্রাণীর মুক্তির জন্য করুণা ও বোধিসত্ত্বের আদর্শকে গুরুত্ব দেয়।
বৌদ্ধ ধর্মের সামাজিক ও নৈতিক প্রভাব
-
সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও মানবিকতার প্রচার।
-
জাতপাত বা বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ।
-
নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা।
-
সমাজে অহিংসা, শান্তি ও সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি।
আধুনিক যুগে বৌদ্ধ ধর্মনীতির প্রাসঙ্গিকতা
আজকের আধুনিক সমাজেও বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মানসিক চাপ, হিংসা, লোভ এবং অস্থিরতার সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের করুণা, ধ্যান এবং অহিংসার নীতি মানুষকে শান্তি ও স্থিরতার পথে পরিচালিত করে।
উপসংহার
বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো হলো – অষ্টাঙ্গিক মার্গ, পাঁচ শীল, দশ শীল, করুণা, অহিংসা ও ধ্যান। এগুলো শুধু একটি ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান নয়; বরং মানুষের জীবনকে সৎ, নৈতিক, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক করে তুলতে সহায়ক। বুদ্ধের শিক্ষা আজও বিশ্ববাসীর জন্য শান্তি, মৈত্রী ও মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে প্রাসঙ্গিক।
