কোরবানি দেওয়ার সঠিক ইতিহাস ও নিয়মাবলী: একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা গাইড লাইন।

কোরবানির পশুর ছবি বা ফটো

✨ ইসলাম ধর্মে কোরবানীর ইতিহাস ও নিয়মাবলী: একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা গাইড

🔶 ভূমিকা

কোরবানি বা কুরবানী শব্দটি মুসলমানদের একটি পবিত্র ধর্মীয় ইবাদতের নাম, যা প্রতি বছর ঈদুল আজহার সময় আদায় করা হয়। এটি মূলত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করার মাধ্যমে ঈমানের প্রমাণ প্রদান। কোরবানী শুধু একটি পশু জবাই নয়, বরং এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা ইতিহাস, ত্যাগ ও আত্মনিয়োগের প্রতীক।

🔶 কোরবানীর ইতিহাস

🐏 হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কোরবানীর ঘটনা

ইসলাম ধর্মে কোরবানীর সূচনা হয় হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে আদেশ দেন যেন তিনি নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করতে উদ্যত হন।

কিন্তু যখন তিনি সত্যিই ছুরির মাধ্যমে ছেলের গলা কাটতে উদ্যত হন, তখন আল্লাহ তাআলা জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দেন এবং হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে রক্ষা করেন। এরপর থেকেই মুসলিম উম্মাহ এই কোরবানীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করে থাকে।

📖 কুরআনে উল্লেখ:

"অতঃপর আমি তাকে এক বিরাট কুরবানীর মাধ্যমে মুক্তি দিলাম।"
(সূরা আস-সাফফাত, আয়াত ১০৭)

 

🔶 কোরবানী করার বিধান ও গুরুত্ব

✅ কোরবানী ওয়াজিব কাদের উপর?

কোরবানী করা ইসলাম ধর্মে ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয়) হয় যাদের ওপর নিচের শর্তগুলো প্রযোজ্য:

  • মুসলিম হতে হবে

  • প্রাপ্তবয়স্ক (বালেগ) হতে হবে

  • মুকীম (মুসাফির না হওয়া)

  • নিজস্ব আয় বা সম্পদ থাকলে, যার উপর সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমমূল্যের সম্পদ আছে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব।

🔶 কোরবানীর সময়

কোরবানী করা যায়:

  • ঈদুল আজহার দিন (১০ জিলহজ) এবং

  • পরবর্তী দুই দিন, অর্থাৎ ১১ ও ১২ জিলহজ—মোট তিন দিন

⏰ সময় শুরু হয় ঈদের নামাজের পর থেকে।

🔶 কোরবানীর জন্য উপযুক্ত পশু

🐄 কোন কোন পশু কোরবানী করা যায়?

  • গরু/ষাঁড় – ২ বছরের উপরে

  • ছাগল/ভেড়া/দুম্বা – ১ বছরের উপরে (বা কিছুটা বড় হলে ৬ মাস হলেও চলবে)

  • উট – ৫ বছরের উপরে

🔸 একটি গরু বা উট ৭ জন পর্যন্ত ভাগে কোরবানি করতে পারে, কিন্তু শর্ত হলো সবার নিয়ত এক হতে হবে।

🔶 পশু নির্বাচনের সময় যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে

কোরবানীর পশু হতে হবে:

  • সম্পূর্ণ সুস্থ

  • কোনো অঙ্গহানিক্রান্ত নয় (যেমন কান কাটা, লেজ কাটা)

  • অন্ধ বা খোঁড়া নয়

  • অত্যন্ত দুর্বল নয়

🔶 কোরবানীর নিয়মাবলী

📜 কোরবানীর আগে:

  • পশুর প্রতি সদয় হতে হবে

  • ছুরি ভালোভাবে ধারালো করতে হবে

  • পশুকে পানি খাওয়াতে হবে

🔪 কোরবানীর সময়:

  • বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে জবাই করতে হবে

  • পশুকে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে

  • পশু একেবারে নিঃশেষ প্রাণ ত্যাগ করার আগে চামড়া না ছাড়ানো উচিত নয়

🔶 কোরবানীর গোশত বণ্টন

কোরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করা সুন্নত:

  1. নিজের জন্য এক-তৃতীয়াংশ

  2. আত্মীয়-স্বজনদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ

  3. গরিব ও মিসকিনদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ

⚠️ কেউ যদি সব গোশত নিজের পরিবারে রেখে দেয় তবুও গুনাহ হবে না, তবে বণ্টন করলে তা উত্তম।

🔶 কোরবানীর চামড়া

চামড়া দান করা যায় মসজিদ, মাদরাসা বা গরীবদের। তবে কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে চামড়া বিক্রি করে অর্থ নেয়া জায়েজ নয়, যদি না সে দান হিসেবে নিয়ে নেয়।

🔶 নারীদের কোরবানী

নারীর যদি কোরবানীর শর্ত অনুযায়ী সম্পদ থাকে, তাহলে তার জন্যও কোরবানী করা ওয়াজিব। তারা চাইলে নিজে করতে পারেন বা অভিভাবকের মাধ্যমে করতে পারেন।

🔶 শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের কোরবানী

অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর ওপর কোরবানী ওয়াজিব নয়। তবে বাবা-মা চাইলে সন্তানের পক্ষ থেকে সুন্নত হিসেবে কোরবানী দিতে পারেন।

🔶 কোরবানীর কিছু ভুল ধারণা ও প্রচলিত ভুল

🔴 ভুল: কোরবানীর দিন শুধু বড় পশু কোরবানি করাই ভালো।
সঠিক: ছাগল বা ভেড়া কোরবানি করলেও সওয়াব সমান, নিয়ত ও আন্তরিকতা গুরুত্বপূর্ণ।

🔴 ভুল: কোরবানীর গোশত রান্না করে খাওয়া যাবে না, দান করতেই হবে।
সঠিক: খাওয়াও যাবে, দানও করা যাবে।

🔴 ভুল: কোরবানীর পশুর নাম রাখতে হয়
সঠিক: নাম রাখা জায়েজ হলেও কোনো বাধ্যতামূলক বিষয় নয়।

✅ উপসংহার

কোরবানি হলো মুসলমানদের জন্য একটি মহান ইবাদত ও আত্মত্যাগের পরীক্ষা। এটি শুধু পশু জবাই নয়, বরং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য এবং আত্মনিয়োগের প্রকাশ। তাই সঠিক নিয়মে, আন্তরিকতার সাথে কোরবানি পালন করলে এর প্রতিদান আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য অবশ্যই মঞ্জুর করবেন।

"নিজে পড়ুন এবং অন্যদের পড়ার জন্য লিঙ্কটি শেয়ার করুন।"


Next Post Previous Post