বাহাই ধর্মের প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো আলোচনা করা হয়েছে। The main principles of the Bahá'í Faith are discussed.

 ভূমিকা

মানব ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে মানুষকে পথ দেখানোর জন্য পৃথিবীতে নেমে এসেছেন বহু নবী, রাসূল ও ধর্মপ্রবর্তক। প্রতিটি ধর্মই মানুষের জন্য শান্তি, ন্যায়, প্রেম ও সত্যের বাণী নিয়ে এসেছে। উনবিংশ শতাব্দীতে ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করা বাহাউল্লাহ (Bahá’u’lláh) প্রতিষ্ঠা করেন এক নতুন ধর্ম – বাহাই ধর্ম (Bahá’í Faith)। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে বাহাই ধর্মাবলম্বী মানুষ ছড়িয়ে আছে এবং জাতিসংঘের কাছেও এটি একটি স্বীকৃত বৈশ্বিক ধর্ম।

বাহাই ধর্মের ডিজিটার ছবি বা ফটো

বাহাই ধর্ম মূলত বিশ্বমানবতার ঐক্য, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী-পুরুষ সমতা, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেয়। বাহাই ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীর সব ধর্মই আসলে একে অপরের পরিপূরক এবং প্রতিটি যুগে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী আল্লাহ বা ঈশ্বর নবী-রাসূলের মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দেন।

এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিত জানব বাহাই ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতি, শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা সম্পর্কে।

বাহাই ধর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বাহাই ধর্মের সূচনা হয় উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইরানে। বাহাই ধর্মের মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে "বাব আন্দোলন" থেকে, যার প্রবর্তক ছিলেন সাইয়্যিদ আলি মুহাম্মদ, যিনি পরিচিত ছিলেন "বাব" নামে। তিনি ঘোষণা দেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন মহান দূত আসবেন যিনি মানব জাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবেন।

পরে বাহাউল্লাহ নিজেকে সেই প্রতিশ্রুত দূত হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, মানবজাতি একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে বিশ্বমানবতার ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। তাঁর শিক্ষাগুলোই পরবর্তীতে বাহাই ধর্মের মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজ বাহাই ধর্ম বিশ্বের ২০০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে আছে এবং এর অনুসারীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও জাতিগত প্রেক্ষাপট থেকে আগত হলেও এক সাধারণ বিশ্বাসে আবদ্ধ।

বাহাউল্লাহর শিক্ষা

বাহাউল্লাহর শিক্ষা মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়ানো—

  1. আধ্যাত্মিক শিক্ষা – মানুষ যেন আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে এবং নৈতিকভাবে সঠিক জীবনযাপন করে।

  2. সামাজিক শিক্ষা – মানব জাতির ঐক্য, সমতা, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা।

  3. নৈতিক বিধান – দৈনন্দিন জীবনে সততা, সত্যবাদিতা, পরিশ্রম, প্রার্থনা ও উপাসনা পালন।

বাহাই ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো

১. এক ঈশ্বর ও এক মানবজাতি

বাহাই ধর্মের মূল শিক্ষা হলো— ঈশ্বর এক, মানবজাতি এক, এবং সব ধর্মই মূলত একই সত্যের বহিঃপ্রকাশ।
এখানে জাতি, বর্ণ, ধর্ম, গোষ্ঠী বা ভৌগোলিক বিভাজনকে অস্বীকার করা হয়। বাহাই ধর্ম মানবজাতিকে এক পরিবার হিসেবে গণ্য করে।

২. নবীদের ঐক্য

বাহাই ধর্মে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যেসব নবী বা ধর্মপ্রবর্তক এসেছেন—যেমন কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, মুহাম্মদ (সা.), এবং অন্যরা—তাঁরা সকলেই ঈশ্বরের পাঠানো দূত। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী তাঁরা আল্লাহর দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছেন।

৩. নারী-পুরুষ সমতা

বাহাই ধর্মের একটি বিশেষ দিক হলো নারী-পুরুষ সমানাধিকার। বাহাউল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোনো সমাজ নারীর অবদান ছাড়া পূর্ণতা পায় না। তাই শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকা জরুরি।

৪. বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়

বাহাই ধর্মে বলা হয়, ধর্ম ও বিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক।
যদি কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস বিজ্ঞানের বিপরীতে যায়, তবে সেটি সঠিক নয়। আবার বিজ্ঞানও নৈতিকতা ছাড়া ক্ষতিকর হতে পারে। তাই উভয়ের সমন্বয়ে মানবজাতির অগ্রগতি সম্ভব।

৫. সর্বজনীন শিক্ষা

বাহাই ধর্মে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। প্রতিটি শিশু, ছেলে বা মেয়ে, ধনী বা গরিব—সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা বাহাই ধর্মের অন্যতম প্রধান নীতি। কারণ শিক্ষা ছাড়া মানুষ প্রকৃত উন্নত হতে পারে না।

৬. বৈষম্য ও কুসংস্কারের অবসান

বাহাই ধর্মে জাতি, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, সামাজিক মর্যাদা বা অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে কোনো বৈষম্যকে সমর্থন করা হয় না।
তারা বিশ্বাস করে, সব ধরনের কুসংস্কার, বিদ্বেষ ও বিভেদ দূরীকরণ মানবতার ঐক্যের জন্য অপরিহার্য।

৭. দারিদ্র্য ও ধন বৈষম্যের সমাধান

বাহাই ধর্মে শেখানো হয় যে, পৃথিবীতে দারিদ্র্য ও ধন বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। ধনীকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে এবং সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে উন্নতির সুযোগ দিতে হবে।

৮. বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা

বাহাই ধর্মে বলা হয়, জাতিসংঘের মতো একটি বৈশ্বিক সরকার থাকা উচিত যা সব দেশের মধ্যে শান্তি, সহযোগিতা ও ন্যায় নিশ্চিত করবে। যুদ্ধ, রক্তপাত বা সন্ত্রাস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

৯. দৈনন্দিন প্রার্থনা ও নৈতিক জীবন

প্রতিটি বাহাই ধর্মাবলম্বীর জন্য দৈনিক প্রার্থনা করা বাধ্যতামূলক। এছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, পরিশ্রম, অন্যের সেবা করা, মদ্যপান ও মাদক থেকে দূরে থাকা বাহাই নৈতিক জীবনের অংশ।

১০. উপবাস ও উপাসনা

বাহাই ধর্মে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় ১৯ দিন উপবাস রাখা হয়। এছাড়া পবিত্র গ্রন্থ পাঠ, প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার নির্দেশ রয়েছে।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা

বাহাই ধর্মে আধ্যাত্মিক উন্নতি মানুষের জীবনের আসল উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচিত।

  • ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস

  • প্রার্থনা ও ধ্যান

  • সৎ চরিত্র গঠন

  • অন্যকে সাহায্য করা
    এসবকেই আধ্যাত্মিক উন্নতির মূল উপাদান ধরা হয়।

সামাজিক শিক্ষা

বাহাই ধর্মে সামাজিক উন্নতির জন্য যে শিক্ষাগুলো দেওয়া হয়েছে তা হলো—

  • জাতিগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা

  • বিশ্ব শান্তি

  • শিক্ষার প্রসার

  • নারীর ক্ষমতায়ন

  • দারিদ্র্য বিমোচন

নৈতিক বিধান

বাহাই ধর্মে নৈতিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাহাউল্লাহ বলেন—

  • সত্য কথা বলা

  • সততা বজায় রাখা

  • পরিশ্রম করা

  • অন্যকে কষ্ট না দেওয়া

  • মাদক, জুয়া ও অসামাজিক কাজ থেকে বিরত থাকা
    এসবই বাহাই নৈতিক বিধানের অংশ।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান

বাহাই ধর্মে প্রতি মাসের ১৯ তারিখে বিশেষ সমাবেশ হয় যাকে “১৯ দিনের ভোজ” (Nineteen Day Feast) বলা হয়। এখানে প্রার্থনা, আলোচনা ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সমাবেশ করা হয়।
তাছাড়া নববর্ষ (নওরোজ), জন্মদিন ও বাহাউল্লাহর শিক্ষা প্রচারের বিশেষ দিনগুলোও উৎসব হিসেবে পালিত হয়।

বর্তমান বিশ্বে বাহাই ধর্মের প্রভাব

আজ বাহাই ধর্ম বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মগুলোর একটি। এটি জাতিসংঘে স্বীকৃত এবং বৈশ্বিক শান্তি, শিক্ষা, সমতা ও মানবতার জন্য কাজ করছে। উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য দূরীকরণ—এসব ক্ষেত্রে বাহাই সম্প্রদায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

উপসংহার

বাহাই ধর্ম এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছে মানব সমাজে। এখানে ধর্ম শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যম নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন ও মানবতার কল্যাণের হাতিয়ার।
এর মূলনীতি হলো— ঈশ্বর এক, মানবজাতি এক এবং ধর্মও মূলত এক।
আজকের বিভাজন, যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের যুগে বাহাই ধর্মের শিক্ষাগুলো মানুষের জন্য একটি আলোর দিশারী হতে পারে।

Next Post Previous Post