জৈন ধর্মের প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো আলোচনা করা হয়েছে। The main religious principles of Jainism are discussed.
ভূমিকা
জগতে বহু প্রাচীন ধর্ম রয়েছে, যার মধ্যে জৈন ধর্ম অন্যতম। এটি ভারতের একটি আদি ধর্ম, যার মূল শিক্ষা অহিংসা, সত্য, সংযম এবং আত্মশুদ্ধি। জৈন ধর্ম অনুসারীরা মনে করেন, জীবনের উদ্দেশ্য হলো আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা এবং জন্ম–মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া। এই মুক্তিকে তারা বলে মোক্ষ।
জৈন ধর্মে দৈনন্দিন জীবনের আচরণ, চিন্তা, কথা এবং কাজে বিশেষ কিছু ধর্মনীতি পালন করার উপর জোর দেওয়া হয়। এগুলো শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, বরং সামাজিক শান্তি, নৈতিকতা ও মানবকল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো জৈন ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো, যেগুলো শত শত বছর ধরে অনুসারীদের জীবনে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে।
জৈন ধর্মের মূল দর্শন সংক্ষেপে
জৈন ধর্মের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি মূল দর্শনের উপর—
-
অহিংসা (অহিংসা পরম ধর্ম) – জীবহত্যা পরিহার করা, প্রাণী–পোকা–পতঙ্গ সকল জীবের প্রতি সমান দয়া।
-
অনেকান্তবাদ – সত্যকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়, তাই সহনশীলতা ও ভিন্নমতকে সম্মান দেওয়া।
-
অপরিগ্রহ – ভোগবিলাস ও বস্তুগত লালসা থেকে বিরত থাকা।
-
আত্মসংযম – কামনা–বাসনা নিয়ন্ত্রণ করে পবিত্র জীবনযাপন।
জৈন ধর্মের প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো
১. অহিংসা (অহিংসা পরম ধর্ম)
-
জৈন ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি হলো অহিংসা।
-
শুধু মানুষ নয়, ক্ষুদ্রতম জীব পর্যন্ত হত্যা করা যাবে না।
-
মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ, কৃষিকাজেও অনেক সময় এড়িয়ে চলেন কারণ তাতে পোকামাকড় মারা যায়।
-
অহিংসা মানে শুধু শারীরিক ক্ষতি না করা নয়, বরং কথায়, মনে এবং কাজে কোনো ধরনের হিংসা না করা।
২. সত্য (সত্য বলা ও মিথ্যা পরিহার)
-
মিথ্যা বলা পাপ হিসেবে গণ্য।
-
সত্য ভাষণ মানে এমন কথা বলা যা অন্যকে কষ্ট না দেয়।
-
কঠোর বা আঘাতমূলক সত্যও জৈন ধর্মে বারণ করা হয়।
৩. অচৌর্য (চুরি পরিহার)
-
অন্যের অনুমতি ছাড়া কিছু গ্রহণ করা জৈন ধর্মে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
-
শুধু বস্তু নয়, অন্যের অধিকার বা সুযোগও আত্মসাৎ করা অনৈতিক।
-
এই নীতি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
৪. ব্রহ্মচর্য
-
গৃহস্থ জৈনদের জন্য ব্রহ্মচর্য মানে দাম্পত্য জীবনে সংযমী থাকা।
-
সন্ন্যাসীদের জন্য এটি সম্পূর্ণ অবিবাহিত জীবন, ইন্দ্রিয় দমন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ।
-
এর মাধ্যমে আত্মাকে শুদ্ধ করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
৫. অপরিগ্রহ (অতিরিক্ত সম্পদ ও ভোগবিলাস ত্যাগ)
-
অতিরিক্ত ধনসম্পদ, জমি, গৃহ, অলংকার বা বিলাসবহুল বস্তু অর্জনের প্রতি আসক্তি বারণ।
-
জীবনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে।
-
এভাবে বৈষয়িক লোভ কমিয়ে আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব হয়।
গৃহস্থ ও সন্ন্যাসীদের ধর্মনীতি
জৈন ধর্মে দুই ধরনের মানুষকে আলাদা করে দেখা হয়—
-
শ্রাবক (গৃহস্থ অনুসারী)
-
সাধু/সাধ্বী (সন্ন্যাসী/সন্ন্যাসিনী)
গৃহস্থের জন্য পালনীয় নীতি
-
আংশিক বা সীমিত প্রতিজ্ঞা (অণুব্রত) গ্রহণ করতে হয়।
-
ব্যবসা বা কৃষিকাজে অহিংসার চেষ্টা করা।
-
মাংস–মদ থেকে বিরত থাকা।
-
পরিবারে শান্তি বজায় রাখা।
-
দান–ধ্যান ও ধর্মকর্ম করা।
সন্ন্যাসীদের জন্য পালনীয় নীতি
-
কঠোর অহিংসা পালন।
-
সর্বদা পদযাত্রা, গাড়ি ব্যবহার নয় যাতে জীবহানি না হয়।
-
নিরামিষ খাদ্য ও নির্দিষ্ট সময়ে অল্প আহার।
-
পরম ব্রহ্মচর্য পালন।
-
ভিক্ষানির্ভর জীবনযাপন।
জৈন ধর্মে প্রতিদিনের সাধনা
-
সময়সার নামক দর্শন অনুযায়ী প্রতিদিন ধ্যান ও প্রার্থনা অপরিহার্য।
-
ভোরে ও রাতে বিশেষ মন্ত্র পাঠ করা হয়।
-
উপবাস জৈন ধর্মে অন্যতম প্রধান সাধনা, যা আত্মসংযম বৃদ্ধি করে।
-
পরিবেশ ও জীবজগতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
জৈন ধর্মের অনন্য কিছু আচারনীতি
উপবাস ও তপস্যা
-
উপবাস হলো আত্মশুদ্ধির পথ।
-
বছরের বিভিন্ন সময়ে “পর্যুষণ” উৎসবে জৈনরা দীর্ঘ উপবাস করেন।
-
খাদ্যগ্রহণ সীমিত করে আত্মসংযম বাড়ানো হয়।
দান বা পরোপকার
-
অন্যের কল্যাণে সম্পদ ব্যবহার করা।
-
দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করা।
-
প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা।
পরিবেশ সুরক্ষা
-
জৈন ধর্ম প্রকৃতি রক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।
-
বৃক্ষনিধন কমানো, প্রাণীদের রক্ষা করা এবং জল–বায়ু দূষণ থেকে বিরত থাকা ধর্মীয় দায়িত্ব।
জৈন ধর্মের পাঁচটি প্রধান প্রতিজ্ঞা (মহাব্রত)
সাধু–সাধ্বীরা যেসব ব্রত মানেন তা হলো—
-
অহিংসা
-
সত্য
-
অচৌর্য
-
ব্রহ্মচর্য
-
অপরিগ্রহ
এই পাঁচটি ব্রতকে বলা হয় মহাব্রত। এগুলো কঠোরভাবে পালন করলে আত্মা পাপমুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ সম্ভব।
সমাজে জৈন ধর্মনীতির প্রভাব
-
ভারতীয় সংস্কৃতিতে অহিংসার যে ধারণা মহাত্মা গান্ধী গ্রহণ করেছিলেন, তার শিকড় রয়েছে জৈন ধর্মে।
-
দয়া, সত্যবাদিতা ও সংযম মানুষকে মানবিক সমাজ গঠনে সহায়তা করে।
-
ভোগবিলাস কমিয়ে প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক।
উপসংহার
জৈন ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো মানবজীবনে শান্তি, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ দেখায়। অহিংসা, সত্য, সংযম, দানশীলতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়, বরং একটি উন্নত সমাজ গড়ার ভিত্তি।
আজকের ভোগবাদী দুনিয়ায়ও যদি আমরা জৈন ধর্মের এই নীতিগুলো মেনে চলতে পারি, তবে সমাজে অন্যায়, হিংসা ও বিভেদের জায়গা অনেক কমে যাবে। তাই জৈন ধর্মের এই শিক্ষা সার্বজনীন ও কালজয়ী।
