শিন্তো ধর্মের প্রধান পালনীয় ধর্মনীতিগুলো আলোচনা করা হয়েছে। The main religious principles of Shinto religion are discussed.

 ভূমিকা

শিন্তো (Shinto) হচ্ছে জাপানের প্রাচীনতম ধর্মগুলোর একটি, যা মূলত প্রকৃতিপূজা, পূর্বপুরুষ পূজা এবং নৈতিক জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। “শিন্তো” শব্দটির অর্থ হলো “দেবতাদের পথ” (Way of the Gods)। জাপানিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে শিন্তো ধর্মের প্রভাব এখনো প্রবল।

শিন্তো ধর্মের ডিজিটার ছবি বা ফটো

শিন্তো ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো – এখানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থ নেই, নেই কোনো প্রতিষ্ঠিত নবী বা একক দেবতা। বরং অসংখ্য কামি (Kami) অর্থাৎ দেবশক্তি বা আত্মাকে পূজা করা হয়। এই কামিরা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানে বিদ্যমান – যেমন পাহাড়, নদী, সূর্য, চাঁদ, সমুদ্র, পশুপাখি, এমনকি মানুষও।

এই পোস্টে আমরা শিন্তো ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতি (Shinto Principles) বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

শিন্তো ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য

শিন্তো ধর্মকে বোঝার জন্য আগে এর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানা জরুরি। যেমন –

  • প্রকৃতিনির্ভর ধর্ম

  • অসংখ্য দেবশক্তি বা কামি পূজা

  • শুদ্ধতা ও পবিত্রতা বজায় রাখা

  • পূর্বপুরুষ পূজা

  • নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন

শিন্তো ধর্মে কামির ধারণা

শিন্তো ধর্মে কামি হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তি বা দেবতা, যারা পৃথিবী ও মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে।

  • প্রকৃতির কামি – পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সূর্য ইত্যাদি।

  • পূর্বপুরুষের কামি – মৃত পূর্বপুরুষরা আত্মারূপে পূজিত হন।

  • সামাজিক কামি – কোনো বীরপুরুষ বা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বও কামি হিসেবে পূজিত হতে পারেন।

শিন্তো ধর্মের প্রধান প্রধান পালনীয় ধর্মনীতি

১. পবিত্রতা (Purity)

শিন্তো ধর্মে পবিত্রতা বা শুদ্ধতা (Misogi এবং Harae) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করা হয়, অপবিত্রতা দূর করতে হলে আত্মাকে শুদ্ধ করতে হবে। এজন্য পানি দ্বারা শরীর ধোয়া, উপাসনালয়ে প্রবেশের আগে হাত-মুখ ধোয়া ইত্যাদি রীতি মানা হয়।

২. প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা

শিন্তো ধর্মে প্রকৃতিকে দেবতুল্য মনে করা হয়। পাহাড়, গাছ, ফুল, নদী সবকিছুতেই কামি বিদ্যমান। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করা শিন্তো ধর্মের অন্যতম নীতি।

৩. পূর্বপুরুষ পূজা

নিজেদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সম্মান করা শিন্তো ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাড়িতে বিশেষ বেদি বা উপাসনালয়ে তাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়।

৪. সততা ও নৈতিকতা

শিন্তো ধর্ম মতে, মানুষের জীবনে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, এবং দায়িত্বশীলতা থাকা জরুরি। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতাই নৈতিকতার মূল ভিত্তি।

৫. উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠান

শিন্তো ধর্মে বিভিন্ন উৎসব (Matsuri) পালিত হয়। এগুলো মূলত কামিদের সন্তুষ্ট করার জন্য। উৎসবগুলোতে গান, নৃত্য, শোভাযাত্রা, এবং দান-ধ্যান করা হয়।

৬. পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব

শিন্তো ধর্মে পরিবার হলো সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইউনিট। পরিবারকে সম্মান করা, বয়োজ্যেষ্ঠদের মান্য করা, সমাজে অবদান রাখা – এগুলো পালনীয় ধর্মনীতি হিসেবে গণ্য।

৭. শান্তি ও ঐক্য রক্ষা

শিন্তো ধর্ম মতে, সমাজে শান্তি, ঐক্য ও সহযোগিতা বজায় রাখা প্রত্যেকের দায়িত্ব। তাই সামাজিক দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলা এবং ঐক্যের প্রচেষ্টা করাকে ধর্মীয় নীতি হিসেবে ধরা হয়।

শিন্তো ধর্মে উপাসনালয় ও পূজা

শিন্তো ধর্মের উপাসনালয়কে বলা হয় শিন্তো শ্রাইন (Shinto Shrine বা Jinja)। এখানে কামিদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা হয়।

  • প্রবেশের আগে হাত ও মুখ ধোয়া হয়।

  • প্রার্থনার সময় দু’বার হাততালি দেওয়া হয়, যাতে কামির দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

  • দানপত্র (অর্থ বা খাদ্য) অর্পণ করা হয়।

শিন্তো ধর্মের উৎসব (Matsuri)

শিন্তো ধর্মে প্রায় প্রতিটি মৌসুমে কোনো না কোনো উৎসব পালিত হয়। যেমন –

  • নববর্ষ উৎসব (Shogatsu) – বছরের শুরুতে কামির কাছে প্রার্থনা।

  • ফসল উৎসব (Niinamesai) – নতুন ফসলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

  • ওবন উৎসব (Obon) – পূর্বপুরুষদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা।

নৈতিক জীবনযাপন ও সামাজিক দায়িত্ব

শিন্তো ধর্ম মতে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হলো –

  • পবিত্র ও শুদ্ধ থাকা,

  • পরিবার ও সমাজকে সম্মান করা,

  • প্রকৃতিকে ভালোবাসা,

  • কামির প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করা।

আধুনিক জাপানে শিন্তো ধর্ম

বর্তমানে জাপানে অনেকেই বৌদ্ধধর্ম ও শিন্তো ধর্মের মিশ্র সংস্কৃতি পালন করে। জন্ম, বিয়ে, উৎসব ইত্যাদিতে শিন্তো ধর্মের আচার পালন করা হলেও মৃত্যু ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বেশি দেখা যায়।

উপসংহার

শিন্তো ধর্ম মূলত প্রকৃতি, পূর্বপুরুষ, পরিবার ও সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এখানে কোনো কঠোর ধর্মগ্রন্থ বা আইন নেই, বরং নৈতিকতা, শুদ্ধতা, শান্তি এবং প্রকৃতিপ্রেমই প্রধান ধর্মনীতি।

আজকের আধুনিক জাপানেও শিন্তো ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং একটি জীবনদর্শন।


Next Post Previous Post