খাদ্যোর উপাদান, পুষ্টিগুন ও উৎস সমুহঃ (Food ingredients, nutrients and sources)

 

Vitamin Foods

দৈনিক একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের পুষ্টি চাহিদা অনুযায়ী কতটুকু খাদ্য প্রয়োজন?

একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের পুষ্টি চাহিদা তার পরিশ্রম ও দেহের ওজন এর উপর নির্ভর করে। ক্যালরির ৬০-৭০ শতাংশ নানা প্রকার কার্বোহাইড্রেট থেকে, ২৫-৩০ শতাংশ স্নেহ জাতীয় পদার্থ থেকে ও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

পুষ্টির চাহিদা অনুযায়ী কোন খাবার কতটুকু পরিমাণ গ্রহণ করতে হবে তা নিচে আলোচনা করা হলঃ

দৈনিক ২৭০-৪৫০ গ্রাম চাল, আটা, ভুট্টা জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। এর সাথে ৩০০-৬০০ গ্রাম শাক-স্ববজি। এবং ১৫০-৩৫০ গ্রাম মাছ, মাংস, ডিম খেতে হবে। এ ছাড়া সুস্থ থাকার জন্য একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে প্রতিদিন ৩০-৪৫ মিলি তেল এবং চর্বি ও ৩০-৬০ গ্রাম ডাল জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। মানুষের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য শুধুমাত্র ভাত-মাছ খেলেই যথেষ্ট পুষ্টি হয় না। এর সাথে খাদ্য তালিকায় দুধ এবং দুধ জাতীয় খাবার প্রতিদিন ১৫০-৪৫০ মিলি, কাচা ফলমুল ১০০-২০০ গ্রাম ও চিনি ১৫-২৫ গ্রাম থাকতে হবে।

মানব দেহের শক্তির প্রধান উৎস হল খাবার। সালোকসংশ্লেষণ এর প্রক্রিয়াকালে সৌরশক্তি উদ্ভিজ খাদ্যের ভিতরে স্হৈতিকক্তিরুপে আবদ্ধ বিদ্যামান। জীবকোষের শ্বসনের সময় স্থৈতিক শক্তি তাপ শক্তি এবং গতিশক্তি রুপে মুক্ত হয়, মানব দেহের সকর ধরনের বিপাক ক্রিয়া, যেমন,শসন,রেচন ও পুষ্টি গ্রহণ ইত্যাদি। শারীর এর  যাবতীয় বৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ, যেমন,বৃদ্ধি,চলা-চল,প্রজনন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয় থাকে। তাই জীবন ধারণের জন্য প্রত্যেক প্রাণীকেই খাবার গ্রহণ করতে হয়। যে সব খাবার সামগ্রী গ্রহণ করলে মানব দেহের বৃদ্ধি,পুষ্টি,শক্তি,ক্ষয়পূরন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হয় তাকেই খাদ্য বলে।

খাদ্য উৎসঃ

পৃথীবিতে বেশিরভাগ খাবার উদ্ভব হয় উদ্ভিদ থেকে। কিছু খাদ্য সরাসরি উদ্ভিদ এর মাধ্যেমে পাওয়া যায়। এমনকি প্রাণির খাদ্যর উৎস হিসাবে আমরা ব্যবহার করে থাকি। সিরিয়াল নামক শস্যটি একটি প্রধান খাদ্য যা অন্য যেকোন ফসলের চেয়ে সারাবিশ্বে বেশি খাদ্যশক্তি উৎস সরবরাহ করে। বিশ্বব্যাপী সকল শস্য উৎপাদনের প্রায় ৮৭ ভাগ জুড়ে আছে ভুট্টা,গম ও চাউল বা এই জাতীয় উদ্ভিদ থেকে। সারাবিশ্বে উৎপাদিত বেশিরভাগ শস্যা প্রাণিসম্পদগুলিকে বৃদ্ধি করতে ব্যবহার করা হয়। প্রাণী বা উদ্ভিদ উৎস নয় এমন কিছু খাবারের মধ্যে বিভিন্ন ভোজ্য ছত্রাক ব্যবহৃত হয়,বিশেষ করে মাশরুম অন্তর্ভু। খামিরযুক্ত ও আচারযুক্ত খাবার তার মধ্যে যেমন,খামিরযুক্ত রুটি,অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়,পনির,আচার,কম্বুচা ও দই তৈরিতে ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আর একটি উৎস হল নীল-সবুজ শেওলাযেমন,স্পিরুলিয়া। অজৈবজাতীয় পদার্থ লবণ,বেকিং সোডা ও টারটার ক্রিম ব্যবহার করে কোনও উপাদান সংরক্ষণ বা রাসায়নিক ভাবে পরিবর্তিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

উদ্ভিদ থেকে খাবার এর উৎসঃ

সারাবিশ্বে খাদ্য হিসাবে খাওয়ার চাষ করা হয় প্রায় ২,০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। আবার এই উদ্ভিদগুলোর বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের স্বতন্ত্র জাত রয়েছে। মানুষ সহ পৃথীবীর অন্যান্য প্রাণীর জন্য গাছের বীজ হল খাবারের একটি উৎস । এ খাবারগুলো ওমেগা ফ্যাটগুলির মতো বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্যকর ফ্যাট সহ উদ্ভিদের প্রাথমিকভাবে বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি বিদ্যামান থাকে। মানুষের ভোজ্য বেশিরভাগ খাদ্যই বীজভিত্তিক হয়ে থাকে। ভোজ্য বীজের মধ্যে সিরিয়াল অন্যতম এগুলো বীজ জাতীয় যেমন,মটরশুটি,মসুর ডাল, কলাই ডাল,বাদাম ইত্যাদি । তৈলবীজগুলোকে সমৃদ্ধ তৈল উৎপাদন করতে পিষে নিতে হয় যেমন,সূর্যমুখী,ফ্ল্যাকসিড,রেপিসিড,তিল ইত্যাদি। শাক-স্ববজি ২য় ধরণের উদ্ভিদজ খাদ্য উৎস যা সাধারণত খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে আলু, গাজর,পেঁয়াজ,লেটুস,বাঁশেরকান্ড,শতমূলী,গ্লোব,আর্টিচোক,ব্রোকলি,বাঁধাকপি,ফুলকপি,রসুন, কাণ্ড,ওল কপি, মুলা, টমেটা, বেগুন, সিম, পালংশাক,পুইশাক ইত্যাদি।

প্রাণী থেকে খাবার এর উৎসঃ

প্রাণীর মধ্যে যেমন গরু,ছাগল,হাঁস,মুরগী,পায়রা,দুম্বা,মহিষ ইত্যাদি প্রাণীর মাংস ও চর্বি। প্রাণীর দ্বারা উৎপাদিত পণ্যগুলির মধ্যে প্রাণী উৎপাদিত দুধ,পনির,মাখন। এছাড়াও পাখি ও অন্যান্য প্রাণী যারা ডিম দেয়। মৌমাছিরা মধূ সংগ্রহ করে যা জনপ্রিয় মিষ্টি খাদ্য।

6 item foods
খাদ্যোর ৬ টি উপাদান

খাদ্যের উপাদান

খাদ্যের ৬টি উপাদানঃ, যথা- 

১। শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট
২। আমিষ বা প্রোটিন।
৩। স্নেহপদার্থ (কার্বন, হাইড্রোজেন, এবং অক্সিজেন) ।
৪। ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ।
৫। খনিজ লবণ।
৬। পানি।

১। শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট ঃ

কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন মুলত এই তিনটি উপাদান নিয়ে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট গঠিত হয়েছে। ধান, গম,আলু,ওল ভুট্টা,কচু, বিভিন্ন প্রকার বীট, গাজর, বাজরা, খেজুর, আপেল, আঙ্গুর,শাক-স্ববজি, বেল, তরমুজ, আম, কলা,কমলালেবু,বিভিন্ন পাকা ফল,গুড়,চিনি, ইক্ষু রস,দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় সকল খাবার ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমানে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট পাওয়া য়ায়। শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ সুস্থ শরীরে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। এই জন্য শর্করা জাতীয় খাবারকে প্রোটিন বাঁচোয়া খাদ্য বলা হয়ে থাকে।

২। আমিষ বা প্রোটিনঃ

মানব দেহের বৃদ্ধি,কোষ গঠন এবং ক্ষয়পূরণ করা প্রোটিনের প্রধান কাজ। তাপ শক্তি উৎপাদন এবং হরমোন ব্যালেন্স করে থাকে। কার্বন, হাইড্রোজেন,অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন এর সমন্বয়ে প্রোটিন গঠিত হয়। প্রোটিন-অণুতে অনেক বেশী অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্বয় হয়ে থাকে। মাছ,মাংস,দুধ,ডিম,ডাল,সয়াবিন,গম ছানা,বীন,উদ্ভিজ্জ ইত্যাদি খাবারে আমিষ বিদ্যামন। প্রাণিজ প্রোটিন এ অ্যামাইনো এসিড প্রায় সকল খারারে থাকে যার ফলে প্রাণিজ প্রাটিনকে প্রথম শ্রেণির প্রোটিন বলা হয়ে থাকে।

প্রোটিনকে আবার ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. সরল প্রোটিন যেমন, অ্যালবুমিন,গ্লোবিউলিন,হিস্টোন, গ্লয়াডিন,গ্লটেলিন,প্রোটমিন ইত্যাদি সরল প্রোটিন।
২. সংযুক্ত প্রোটিন যেমন, হিমোগ্লোবিন,ফসফোপ্রোটিন,হিমোসায়ানিন,লাইপোপ্রোটিন ইত্যাদি।
৩. লব্ধ প্রোটিন যেমন,পেপটাইড,পেপটন ইত্যাদি।

প্রাণীজ উৎস খাদ্য
প্রাণীজ উৎস

৩। স্নেহপদার্থ বা ফ্যাটঃ

প্রাণীর দেহের তাপ শক্তি উৎপন্ন করা স্নেহ পদার্থ জাতীয় খাদ্যের প্রধন কাজ।
কার্বন,হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন নিয়ে স্নেহপদার্থ বা ফ্যাট গঠিত হয়ে থাকে। ফ্যাট প্রকৃত পক্ষে অ্যাসিড ও গ্লিসারলের সংমিশ্রণে গঠিত এস্টার বিশেষ। বাদাম, নারিকেল, রেড়ী বীজ,তুলা বীজ,সরষে,মাখন,ঘি, চর্বি ইত্যাদিতে প্রাণীজ ফ্যাট থাকে। সাধারন তাপ দিলে যে ফ্যাট তরল অবস্থায় বিদ্যামান থাকে তাদেরকে তেল বলে।

ফ্যাট সাধারনত দুই ধরনের হয়। যথা:
১. সরল ফ্যাট যেমন,ওয়াক্স বা মোম, ল্যানোলিন ইত্যাদি সরল ফ্যাট।
২. যৌগিক ফ্যাট যেমন, ফসফোলিপিড,অ্যামাইনো-লিপিড,গ্লাইকোলিপিড ইত্যাদি।

৪। খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন :

যে বিশেষ জৈব পরিপেষক সাধারণ খাদ্যের অতি অল্প পরিমাণে থেকে দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি এবং দেহের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাকে ভিটামিন বলে। দুধ,ডিম,মাংস,প্রানীদের যকৃৎ,মাছের যকৃৎ নিঃসৃত তেল, মাছ, মাখন, উদ্ভিজ্জ তেল,বাদাম, ঢেঁকিছাটা চাল,লাল আটা, ছোলা, মুগ, বীট, গাজর, মটরশুঁটি, পালংশাক,টমেটো,বাঁধাকপি, ফুলকপি, লেবু, আম, আমলকি,আপেল ইত্যাদি খাবারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন দুভাগে ভাগ করা হয়। যথা:
১. তেল বা স্নেহপদার্থে দ্রবনীয় ভিটামিনঃ যে সব ভিটামিন তৈল বা স্নেহপদার্থে দ্রবীভূত হয় থাকে, তাদেরকে স্নেহপদার্থের দ্রবনীয় ভিটামিন বলে। যেমন A,D,E,K.
২. পানিতে দ্রবনীয় ভিটামিনঃ যে সব ভিটামিন পানিতে দ্রবীত থাকে,তাদের জলে দ্রবনীয় ভিটামিন বলে। যেমন B, C, P.

৫। খনিজ লবণঃ

মানবদেহ গঠন ও সুস্থতা রক্ষার ক্ষেত্রে খনিজ লবন একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। প্রতিদিন আমরা খাবারের সাথে লবণ খাই। এছাড়া আয়োডিনযুক্ত লবন সামুদ্রিক মাছে অধিক পরিমানে রয়েছে। মাছ,ডিম,দুধ,সবুজ শাক-স্ববজি,কাচা ফলমুল,মাংস ইত্যাদি খাবারে খনিজ লবণ বিদ্যামান।

৬। পানিঃ

পানি খাদ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানব দেহে পানি অপরিহার্য ভূমিকা বহন করে। দেহের গঠন ও দেহের অভ্যান্তরীণ কাজ পানি ছাড়া চিন্তাই করা যায়না। আমাদের দেহের ওজনের প্রায় ৬০-৭০% পানি দ্বারা গঠিত। আমাদের দেহের রক্ত, মাংস, স্নায়ু, দাঁত,হাড় প্রতিটি অঙ্গ গঠন এর জন্য পানি প্রয়োজন। দেহকোষ গঠন ও কোষের যাবতীয় প্রক্রিয়াগুলো পানি বিহীন কোনোভাবেই গঠন হওয়া সম্ভব নয়।


লেখাটি পাড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ নিজে জানুন এবং অপরের কাছে  লিঙ্ক শেয়ার করে অন্যদেরকে জানতে সাহায্য করুন।

 

Next Post Previous Post